আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত

 ভাষা মানুষের আত্ম পরিচয় শক্তিশালী মাধ্যম। প্রতিটি জাতির নিজস্ব একটি ভাষা থাকে, যা তাদের পরিচয় ও সংস্কৃতির বাহক। যে ভাষায় আমরা প্রথম শব্দ উচ্চারণ করি অনুভূতি প্রকাশ করি সেই ভাষায় আমাদের মাতৃভাষা।

আন্তর্জাতিক-মাতৃভাষা-দিবস-গুরুত্ব-তাৎপর্য

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও বাঙালীদের জীবনে স্মরণীয় দিন। এই দিন বাঙালি জাতির কিছু সূর্য সন্তান নিজের ভাষার জন্য জীবন দান করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সালাম,  বরকত, রফিক,জব্বার সহ আরো অনেকে ভাষার জন্য শহীদ হন। তাদের এই ত্যাগ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

পেজ সূচিপত্রঃ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য  সম্পর্কে জানুন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির গৌরব আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার জন্য রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার সহ অনেকে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল যেখানে ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এটি শুধু একটি তারিখ নয় বরং একটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস যোগায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই দিনটি আজ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য আমাদের জীবনে অনেক বেশি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। যা মাতৃভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাক্ষী তাই এই দিনে তাৎপর্যও অনেক বেশি ।

২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক পটভূমি

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনে এক অবিচ্ছেদ অধ্যায় যে অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। এ আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি রাজপথে নেমে এসেছিল কৃষক, চাকুরীজীবী, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। শহীদ হয়েছিলেন সালাম,বরকত সহ অফিস যাত্রী শফিউর রহমানসহ নাম না জানা অনেক ব্যক্তি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। একমাত্র বাঙালি জাতি জীবনের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছে মুখের ভাষা।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইংরেজিতে প্রদত্ত ভক্তি তাই বাংলাকে অধিকাংশ জাতি গোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি করলেন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলে এর বীজ বপন হয়েছিল বহুদিন আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে উর্দই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি ক্ষোভের জন্ম হয়। বাংলাভাষী মানুষ এর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরের সমাবেশ মিছিল ইত্যাদি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতি শীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলে যোগ দেন সাধারণ মানুষও। পথশিশু থেকে শুরু করে কর্মজীবী রিক্সা চালক স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। গুলিতে শহীদ হন রফিক সালাম বরকত সহ আরো অনেকে। সৃষ্টি হয় ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া জাতি হিসেবে এক ইতিহাস।

ভাষা আন্দোলনের কারণ ও প্রেক্ষাপট

ভাষা আন্দোলনের কারণ ও প্রেক্ষাপটে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রতিফলন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে দেখা যায়,নতুন রাষ্ট্রটির দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাংলাভাষী। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উদ্যোগে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়। এ সিদ্ধান্ত বাঙালি জনগণের ভাষাগত অধিকার সংস্কৃতি ও পরিচয় এর উপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখা যায়।

বাঙালিরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ভাষা আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক শোষণ ও সংস্কৃতি অবজ্ঞা একটু বড় কারণ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রশাসনিক দমন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ বাঙ্গালীদের ক্ষুব্ধ করে তুলে।১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা করেন, যা আন্দোলনকে আরো জোরদার করে।

ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করে, ভাষা রক্ষার জন্য সংগঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা মিছিল করে, আর সেই দিনই পুলিশ গুলি চালায়, শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে।এই আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকারের জন্য ছিল না, বরং এটি ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের লড়াই। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতিসত্তার বোধ জাগ্রত হয়, যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে ওঠে। সুতরাং ভাষা আন্দোলনের কারণ ও প্রেক্ষাপট বাঙালির ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
আন্তর্জাতিক-মাতৃভাষা-দিবস-গুরুত্ব-তাৎপর্য

জাতিসংঘের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদদের আত্মত্যাগ শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর এই ঘোষণা বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয় এবং অনেক দেশের সমর্থনে তা গ্রহণ করা হয়।

 এই স্বীকৃতির ফলে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মৃতি বিশ্বব্যাপী সম্মানিত হয় এবং ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য রক্ষার বার্তা পৌঁছে যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ ভাষার অধিকার, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুভাষিক শিক্ষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধুই একটি দিবস নয়, বরং বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের জন্য নিজেদের ভাষার মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার এক ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণা।

মাতৃভাষার গুরুত্ব ও সংরক্ষণ

মাতৃভাষা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি, সংস্কৃতি এবং জ্ঞান প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো তার মাতৃভাষা। একটি শিশুর মানসিক বিকাশ, শিক্ষাগ্রহণ এবং সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রাথমিক হাতিয়ারও মাতৃভাষা। তাই মাতৃভাষা শুধু ভাষার বিষয় নয়, এটি একটি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।

কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে অনেক মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাষার বৈচিত্র্য ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাই মাতৃভাষার সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। মাতৃভাষায় শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা, প্রশাসনিক কাজ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করলে ভাষার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যায়। ভাষা সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আত্মমর্যাদা টিকে থাকে। তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার প্রচার ও ব্যবহারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।

পাঠকের শেষ কথা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের অমূল্য শিক্ষা দেয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য যে রক্তঝরা ইতিহাস রচনা হয়েছিল, তা শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, বরং বিশ্বব্যাপী ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রেরণা। এ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভাষাই সংস্কৃতির বাহক, পরিচয়ের মূলভিত্তি। তাই মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং চর্চা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক নিজ ভাষাকে ভালোবাসি, সম্মান করি এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে এর গুরুত্ব তুলে ধরি। ভাষার জন্য ভালোবাসা হোক চিরন্তন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url